গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদান এই বিষয়গুলো খুব স্বাভাবিকভাবে আমরা নিজেদের জীবনে নেই। ধরেই নেই, গর্ভবতী হলেই একজন মা সন্তান জন্মদান বিষয়ে আশেপাশের অন্য সব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মায়ের কাছ থেকে সবকিছু জেনে যাবেন।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনকার ব্যস্ত সময়ের একক পরিবারে এই জানার বিষয়টা আরও অনুপস্থিত। উপরন্ত গর্ভাবস্থায় অবস্থায় মা যখন ডাক্তার দেখান, অনেক রোগীর ভিড়ে, স্বল্প সময়ে ডাক্তারের পক্ষে সবকিছু ব্যাখ্যা করার সম্ভবও হয় না  বেশিরভাগ সময় ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশনে ঔষধ, পথ্য লিখে দেন, আর সময় সময় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক টেস্ট করতে দেন। আলাদা ভাবে রোগীকে বোঝাবেন, বা সময় দিবেন সেটার সুযোগ থাকে না। 

প্রসবের প্রস্তুতিমূলক পড়াশোনা কেন করা দরকার?

প্রথমেই বুঝতে হবে, প্রেগন্যান্সী আমাদের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ন একটা অধ্যায়। একটা মানবশিশুকে নিজের শরীরে ধারণ করে, তার পুষ্টির যোগান দিয়ে, সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনার ব্যবস্থা করা চাট্টিখানি কথা না। গর্ভে থাকা অবস্থাতেই সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করা, তাকে তার জীবনটা সুন্দর উপায়ে শুরু করে দেয়ার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে আমরা মাতৃত্বের একটা সুন্দর সূচনা করতে পারি। আমাদের জীবনের সব গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্তগুলো আমরা খুব চিন্তাভাবনা করে, জেনে বুঝে নেই। তাহলে গর্ভাবস্থার বিষয়ে নয় কেন? 

একজন সন্তানসম্ভবা মায়েদের নিজের গর্ভাবস্থা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন থাকে। এই সময়ে শরীরে ঠিক কি পরিবর্তন ঘটে? কেন ঘটে? কে মুড সুইং হয়? কি খাবো কি খাবে না? কি এক্সারসাইজ করবো ও কেন করবো? কিভাবে লেবারের জন্য প্রস্তুতি নিবো? লেবারের সময় কি হয়? প্রেগন্যান্সীতে কি ধরনের জটিলতা হতে পারে? নরমাল ডেলিভারী নাকি সি-সেকশন ভালো হবে? ডেলিভারীর পর কিভাবে নিজের যত্ন নিবো? বাচ্চার দেখাশুনা কিভাবে করবো? বুকের দুধ কিভাবে খাওয়াবো? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন আর সংশয়ে ভরা প্রেগন্যান্সীর সময়কাল। 

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া একজন মায়ের জন্য খুব জরুরী। কারন এগুলোর উত্তর মাকে সাহায্য করবে পৃথিবীতে তার বাচ্চার শুরুটা সুন্দর করে তুলতে। একজন সম্ভবা মা বা হবু মা হিসেবে প্রেগন্যান্সীর যে কোন সময়ে, নিজের ও বাচ্চার ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত জেনে বুঝে আপনি তখনি নিতে সক্ষম হবেন, যখন প্রেগন্যান্সী ও সন্তান জন্মদান বিষয়ে আপনার যথাযথ পড়াশুনা থাকবে। 

প্রিনাটাল বা চাইল্ড বার্থ ক্লাস বাইরের দেশগুলোতে বেশ জনপ্রিয়। অনেকক্ষেত্রে এধরনের ক্লাসকে Antenatal class ও বলে। সাধারনত অভিজ্ঞ মিডওয়াইফ, নার্স বা প্রশিক্ষিত চাইল্ডবার্থ এডুকেটররা এই ধরনের ক্লাসগুলো নিয়ে থাকেন। একজন হবু মাকে গর্ভাবস্থা ও প্রসব(Labor) সম্পর্কে খুব প্রয়োজনীয় বিষয় জানিয়ে তাকে সামনের দিনগুলোর জন্য প্রস্তুত করতে এই ধরনের ক্লাসের জুড়ি নেই। মেডিক্যাল বিষয়ক কোন পরামর্শ বা চিকিৎসা এখানে দেয়া হয় না। বরং এক সময়ে পরিবারের মা বা বোন থেকে প্র্যাগনান্সী বিষয়ক যে জিনিসগুলো মানুষ জানতে চাইতো, সেগুলোর সময় উপোযোগী, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা সাথে ট্র্যাডিশনাল জ্ঞানের সমন্বয় করে এই ধরনের প্রিনাটাল ক্লাসের আয়োজন করা হয়। 

কেন করবেন প্রিনাটাল ক্লাস?  

  • প্রেগন্যান্সী বিষয়ক প্রস্তুতি নিতে।
  • প্রেগন্যান্সীতে পুষ্টি ও ব্যায়ামের সমন্বয় নিশ্চিত করতে। 
  • প্রেগন্যান্সী ও লেবারের সময় শরীর, মনের যে ধরনের পরিবর্তন ঘটে, তা সম্পর্কে জানতে। 
  • এই সময়ে যে ধরনের মেডিক্যাল হস্তক্ষেপ করা হয়, তার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে জানতে। 
  • প্রেগন্যান্সী ও লেবার বিষয়ক যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় জেনে বুঝে নিতে। 
  • লেবার ও সন্তান জন্মদান বিষয়ে সময় উপযোগী ও বিজ্ঞানস্মত গবেষণা থেকে প্রাপ্ত বিষয়সমূহ জানতে। 
  • সন্তান জন্মদানের সময় ব্যাথা উপশম বিষয়ে ধারনা পেতে। 
  • রিলাক্সেশনের টেকনিকগুলো করায়ত্ব করতে। 
  • বিভিন্ন ধরনের বার্থিং পজিশন সম্পর্কে জানতে এবং নিজের জন্য সঠিকটি বেছে নিতে। 
  • পোষ্ট-পার্টাম কেয়ার সম্পর্কে জানতে। 
  • নতুন শিশুর যত্ন কিভাবে নিতে হবে, যে সম্পর্কে জানতে। 
  • বাচ্চাকে কিভাবে ব্রেষ্টফিডিং করাবেন তার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা নিতে।  

এধরনের ক্লাস কি শুধু মায়েদের জন্যই?

মাতৃত্ব মূলত একজন নারীর শারীরিক বিষয় হলেও সেই নারীর চারপাশের মানুষেরা তার মাতৃত্বে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখে। একজন সম্ভবা মা মাতৃত্বকালীন সময়ে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যান এবং তার আশেপাশের মানুষ, যেমন স্বামী, শ্বাশুড়ি, মা, বোন এমনকি তার বান্ধবী এসময় তার ভাল থাকায় ভূমিকা রাখেন। তাই মাতৃত্বকালীন প্রিনাটাল ক্লাস একজন গর্ভবতী মা যেমন করবে, একই সাথে এই ক্লাসে এই সব মানুষদের অংশগ্রহণ দরকার। মোটাদাগে এধরনের ক্লাসের টার্গেট গ্রুপ এরকম:

  • যারা গর্ভধারণ করতে চাইছেন।
  • ইতোমধ্যে গর্ভধারণ করেছেন। 
  • হবু বাবা। 
  • যারা মা’কে প্রসবের (labor) সময় সাপোর্ট দিবেন বলে ভাবছেন।  

আনুষ্ঠানিক ক্লাস করা কি জরুরী?

অনেকেই ভেবে থাকবেন ইন্টারনেটে তো এত এত তথ্য, ভিডিও বিনামূল্যেই পাওয়া যায়! তাহলে আনুষ্ঠানিক ক্লাস করা কতটা জরুরী?

এই প্রশ্নের উত্তর আপনার নিজের কাছেই আছে। ইন্টারনেটে এখন পাওয়া যায় না এমন কোন বিষয়ই নেই। এরপরও আমরা ধরাবাঁধা ফর্মেটে বিভিন্ন কোর্স করি, কারণ এখানে আমাদের দরকারি তথ্য, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সাজানো গোছানো থাকে। এছাড়াও প্রশিক্ষিত চাইল্ড বার্থ এডুকেটরের অধীনে থেকে কোর্স করা আর নিজে খুঁজে বের করার মাঝে অবশ্যই গুণগত পার্থক্য থাকবে।

গর্ভকালীন অবস্থাটা যেকোন মায়ের জন্য চ্যালেঞ্জিং সময় এবং একজন মা গুগল-ইউটিউবের গলি-উপগলি ঘুরে সঠিক কন্টেন্ট খুঁজে বের করার মানসিকতায় নাও থাকতে পারেন। এছাড়া বেশিরভাগ লেখা ও ভিডিও ইংরেজিতে হওয়ায় ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা আছে অনেকরই। তাই প্রিনাটাল ক্লাস অনেকের জন্যই ভাল সমাধান হতে পারে।

কোথায় পাবো এমন ক্লাস?

মাতৃত্ব থেকে আমরা প্রিনাটাল ক্লাস চালু করেছি এবং গড়পড়তা প্রতি ২মাসে একটা নতুন ব্যাচ শুরু করা হয়। এই কোর্সের ভর্তি কার্যক্রমন সবসময় চালু থাকে।

আমাদের প্রিনাটাল ক্লাসের ফর্ম্যাট এরকমঃ ৮ সপ্তাহে ১৬টি লাইভ ক্লাস যেখানে কোর্স শিক্ষক কোন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং ক্লাস শেষে অংশগ্রহণকারীরা প্রশ্ন করেন। এছাড়াও কোর্সের প্রশিক্ষনার্থীরা একটি প্রাইভেট টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে প্রশিক্ষকদের সাথে যুক্ত থাকেন, যাতে ক্লাসের বাইরের প্রশ্নগুলোও করতে পারেন। প্রতিটি ক্লাসের রেকর্ড থাকে, তাই কোন শিক্ষার্থী ক্লাস মিস করলে পরবর্তীতে দেখে নিতে পারেন। আরো বিস্তারিত জানতে এই পাতাটি দেখুন এবং প্রশ্ন থাকলে মাতৃত্ব ফেসবুক পাতায় মেসেজ করুন।

গর্ভাবস্থা একজন নতুন মায়ের জন্য সম্পূর্ণ অজানা বিষয়, এবং প্রতিটি গর্ভাবস্থা আগের অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্নতর। এবং  এটা নিয়ে জানবে, পড়াশুনা করে নিজেকে প্রস্তুত করবে এটাই প্রত্যেক মায়ের প্রাপ্য। মনে রাখবেন একজন কনফিডেন্ট মা-ই পারেন মাতৃত্বের চমৎকার শুরু নিশ্চিত করতে। প্রেগন্যান্সী, সন্তান জন্মদান বিষয়ে জানুন। বাবাদেরকে উৎসাহিত করুন এই জানায় অংশগ্রহণ করতে।

যৌথ লেখনী

ইসরাত জাহান, সঞ্চালক ও প্রতিষ্ঠাতা, মাতৃত্ব
আফিফা রায়হানা, চাইল্ড বার্থ এডুকেটর, আমানি বার্থ ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা, মাতৃত্ব

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা