বহুভুজ মন

জাকিয়া জেসমিন যূথী ৫ ডিসেম্বর ২০২০, শনিবার, ১১:৪৮:৪০অপরাহ্ন উপন্যাস ১৬ মন্তব্য


আচ্ছা, কয় তলার ওপর থেকে লাফ দিলে মানুষ মরে যায়?
কেমন প্রশ্ন করলেন আফা?
আহা, বলোই না!
না আফা, বলা যাইবো না! আপনে মরা খাইলে শেষে পুলিশে আমারে লই টান দিবো।
ধুর, সব স্বার্থপর!
না আফা, মরার চিন্তা বাদ দিয়া অন্য কিছু কন।
কেন? আমি মরলে কি অসুবিধা? বরং মরে গেলেই সব মুশকিল আসান হয়। সবাই ভালো থাকবে।
কী যে কন না আফা! কেউ কিছু কইছে? মন খারাপ আপনার? ভাইজান রে মিস করতেছেন? হ বুঝছি। এইটাই ...
রিয়াজের কথাগুলো খুব হৃদয় স্পর্শ করে অঞ্জনার। চোখ ছলছল করে ওঠে। কণ্ঠস্বরে দলা পাকায় অব্যক্ত অভিমান। মেসেঞ্জার থেকে দৃষ্টি সরে যায়। অথবা চোখে পরে না আর। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে ভাইয়ের ঘরের ভেঁজানো দরজা কে পাশ কাটিয়ে মায়ের ঘরের দিকে উঁকি দেয়। মেশকাত শরিফ পড়ছেন মা। প্রায় নিঃশব্দে নিজের ঘরেই আবার ফিরে আসে। তারপর জানালার গ্রিল চেপে ধরে দু হাতে। অন্ধকার আকাশে লক্ষ তারার মেলা। কেউ কাউকে না ছুঁয়ে দিব্বি যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কিসের অপেক্ষা ওদের? লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ওরা কি ওভাবেই চেয়ে আছে? ওরা কি ওভাবেই স্থির চেয়ে থাকে? এমন করে কখনো ভাবেনি সে। আজ কদিন ধরে ভাবনাগুলো এভাবে ডালপালা ছড়াচ্ছে। এই যে বেঁচে থাকা, এর সার্থকতা কোথায়? সাত তলার ওপর থেকে নিচে অনেক নিচে সরু রাস্তা। দিনের বেলায় এখানে অগুনতি রিকশার ভিড়। রিকশার বেল, গাড়ির হর্ণ। ব্যস্ত পৃথিবীর একটা অংশ। আবার মাঝেমাঝে একদম ফাঁকা। এই যেমন এখন। রাতের শহর এখন শান্ত রাজপথের মতন ঘুমন্ত। এই ঘুমন্ত পৃথিবীতেই চলে যাবার সঠিক সময়।
অঞ্জনা উপরের আকাশ আর নিচের চোখে না পরা অন্ধকার জমিনের তল খুঁজতে খুঁজতে মৃত্যু ফাঁদ পরিকল্পনা করতে থাকে।


“স্বপ্নে বিভোর”
লাইন দুটি তে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে তুহিন।
স্বপ্ন বিভোর, স্বপ্নে বি-ভোর, স্ব-প-নে-এ-এ-এ-বি-ভো-র...
ওওওফ শব্দ দুটি মাথার ভেতরে তুফান তুলে দিলো। স্বপ-নে বি-ভোর স্বপ-নে বি-ভোর স্বপ-নে-বি-ভোর! খচ খচ খচ খচ! ওফ অসহ্য! অসহ্য! তীক্ষ্ণ হুটোপুটি। কতগুলো পোকা মাথার তালুর ভেতরে ভীষণ ডানা ঝাপটাচ্ছে। বের হবার জন্য জানালা খুঁজছে যেন। চামড়ার নিচে অন্ধের মতন প্রাণপণ ছুটাছুটিতে ধপ ধপ শব্দ তুলে চলেছে। তুহিন মাথার খুলি চেপে ধরলো। মাথা ছাড়িয়ে ধপ ধপ শব্দটা কানের লতিতে নেমে এলো। চোয়াল বেয়ে ব্যথার ধরনটা চলে আসছে দাঁতের দিকে। মাথার ব্যথাটা তাতে কমলো যেন। অথবা ওরা যেন হাতের শক্ত চাপ খেয়ে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছে বলেই ব্যথা কমলো।
ফেসবুক স্ট্যাটাস টা দেখেই মাথায় যন্ত্রণার শুরু। হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরতেই মোবাইল টা হাত থেকে খসে পরে যায় বিছানায় উপরে। বেশ কিছুক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনে আলো জ্বলতে থাকলেও এখন সেটা হালকা হতে হতে নিভে গেলো। ঠিক এই সময়েই মাথার দপদপানি ব্যথাটা দূরে হারিয়ে গেলো।
এখন অনেক রাত। অফিস থেকে ফিরেছে অনেকক্ষণ। ফিরে খেয়েছে। নামাজ সেরেছে। তারপরে একার সংসারের আরও কিছু টুকিটাকি সেরে এসে আধশোয়া হয়েছে বিছানায়। তারপরেই হাতে নিয়েছে মোবাইল ফোনটা। আর সাথে সাথেই ফোন করেছে মা। প্রায় প্রতি রাতেই এই সময়টায় মা ফোন দেয়। কিভাবে যেন মা জেনে যায় যে সব কাজ শেষ করে ছেলেরও ছুটি হয়েছে। এখন সে মন খুলে মায়ের সব কথা শুনতে পারবে। মা ছেলে সারাদিনের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা ঘুমোতে যাওয়ার আগে পরস্পরের সাথে বলে। এ হয়ে গেছে প্রতিদিনের রুটিন।
কিরে খোকা, খেয়েছিস?
হ্যাঁ, মা খেয়ে উঠেছি বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। তুমি খেয়েছো, মা?
হ্যাঁ। আজ তোর পছন্দের তরকারি রেঁধেছিলাম। মিষ্টি কুমড়া দিয়ে ইলিশ মাছ। কিন্তু খেতে বসে বার বার তোর কথা মনে হচ্ছিলো। নিজে হাত পুড়িয়ে কী খাস না খাস। তোর চিন্তায় আমার আর ভালো লাগে না। কবে যে একটা বউ পাবো?
ওই যে আবার শুরু করলে। কেন এমন করো মা? আমি কি কোন অভিযোগ করেছি? বলেছি কি আমি খারাপ আছি? নাকি বউ নেই বলে আমি অসুখ বাঁধিয়েছি, বলো? তেমন হলে আমি কিন্তু তোমাকেই নিয়ে আসতাম। মায়ের হাতের সেবা পাবো বলে। আর এত কিসের বউ বউ করো তুমি? বিয়েটা এত সহজ নাকি? দুটি মনের মিল হতে হবে। কারো বুঝতে হবে আমাকে। আমার ছোট চাকরি! সেক্রিফাইস করার মনোভাব থাকতে হবে তো সেই মেয়েটার। হুট করে একটা মেয়ে দেখলাম আর বিয়ে করে ফেললাম ও আমাকে দিয়ে হবে মা? তুমি তো চেনো তোমার ছেলেকে!
আহা খেপছিস কেন? মা কি তোর খারাপ চায়? তোকে বুঝবে এমন মেয়েই তো আনব আমি। মাকে ভরসা নেই তোর।
বাদ দাও তো।
আর কত বাদ দিবি? বিয়ে থা কি করবিই না? সব বন্ধুদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তুই যে খুব একা আমি কি বুঝি না?
আহা মা! কি বলছো? আমার জন্য তুমি আছো। বাবা আছে। আমার ভাই বোনেরা আছে। বন্ধুরাও আছে।
শুধু আপন মানুষটাই তো নাই যে তোকে আলাদা করে সময় দেবে।
ধুর, এসব বাদ দাও তো। আজকে ইলিশই রাধলে শুধু? সাথে আর কী কী পদ করেছিলে?
শোন, আমাকে ভোলাস না। আমি তোর জন্যে মেয়ে দেখেছি। তোর পছন্দ হবে। ছোটবেলা থেকে চিনিস ওকে। দেখলেই চিনতে পারবি। আমি জানি তোর মনের মতই হবে। আমাদের আর ওদের সংসার সব চেনা জানা। আমি বলবো এ প্রস্তাব খুব ভালোই হবে। তুই শুধু এবার এসে ওকে দেখিস। দেখবি, মায়ের পছন্দে তোর কোন অমত হবেনা।
আচ্ছা, সে পরে দেখা যাবে। যখন বাড়ি যাবো তখন। বাবা কি ঘুমিয়ে গেছে? শরীর কেমন? যেকোন প্রয়োজন বলবে কিন্তু মা। ব্যস্ত থাকি বলে কোনকিছু চেপে যেও না। আর বাবা তো খুব চাপা জানোই তো।
হ্যাঁ, তোকে বলতে হবে না। জানি তো মানুষটাকে। পঁয়ত্রিশ বছর ঘর করলাম। কম সময় তো নয়। নিজের সমস্যা কোনদিনও ধরা দেয় না। কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দেয়া সহজ নয়। তুই চিন্তা করিস না।
দূরে থাকি। তোমাদের খেয়াল করবো সেটাও সম্ভব হয় না। তাই চিন্তা তো হয়ই মা।
থাক চিন্তা করে আর স্বাস্থ্য খারাপ করতে হবে না। ভালোভাবে খাওয়া দাওয়া করিস। নিজের যত্ন নিস।
হু যত্ন তো নেই মা। প্রতিদিনের দেয়া উপদেশ মুখস্ত হয়ে গেছে।
হু, বিয়ে থা কর। সন্তানের বাবা হ। বুঝবি। বাবার মন, মায়ের মন সব বুঝবি।
আচ্ছা সে বুঝবো। অনেক রাত হলো। এবার ঘুমাও তো।
হ্যাঁ, তুইও ঘুমা। রাত জাগিস না। ভোর ভোর উঠিস। রাখলাম।
আল্লাহ হাফেজ।
মা ফোন রেখে দিয়েছে অনেকক্ষণ। এর পরে সত্যি ঘুমনোই প্রয়োজন ছিলো। কেন যে ফেসবুকে লগইন হতে গেলো। না হলেই ভালো ছিলো। ঘুমটা উধাও হয়ে গেছে। মন জুড়ে অস্থিরতা।

(চলবে)

#পর্ব_০২ঃ

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ