এবিএম মূসা: পরিবেশ সাংবাদিকতার এক পথিকৃৎ

এ বি এম মূসা
এ বি এম মূসা

কিংবদন্তি সাংবাদিক এবিএম মূসার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৪ সালের এই দিনে ৮৩ বছর বয়সে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। অন্তরের গহীন অলিন্দ থেকে জানাই অতল শ্রদ্ধা। যেখানেই থাকুন, প্রয়াত মূসা ভাই সমুজ্জ্বল থাকুন আকাশের ওই তারার সাথে, চির সবুজ সতেজ থাকুন।

‘মূসা কেমন আছে’- ব্যাংকক এয়ারপোর্টে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলেন ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান সম্পাদক চঞ্চল সরকার । চঞ্চল এশিয়া-প্যাসিফিক পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের (আফেজ) প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন, গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি। আফেজের প্রথম চেয়ারম্যান রাইজিং নেপাল সম্পাদক আদিত্য মানশ্রেষ্ঠ দেখা হলেই খোঁজ নিতেন আমাদের প্রিয় মূসা ভাইয়ের। আফেজের আরেক চেয়ারম্যান মালয়েশিয়ার স্টেট টাইমস সম্পাদক ফিলিপ ম্যাথুস ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। টেকসই উন্নয়নের এক দিকপাল শ্রীলংকার টারজি ভিটাচিসহ পুরো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের দেশে দেশে ছড়িয়ে রয়েছেন মূসা ভাইয়ের অনেক বন্ধু, সহকর্মী।

বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম (এফইজেবি) সাধারণ সম্পাদক ও চেয়ারম্যান হিসেবে আমার কেটেছে ২৭ বছর। আফেজ মহাসচিব আর চেয়ারম্যান হিসেবে পার করেছি ২১ বছর। এ সময় যে দেশেই গিয়েছি, মূসা ভাইয়ের অগণিত বন্ধু-সহকর্মীর সান্নিধ্য পেয়েছি। বাড়তি আতিথেয়তা মমতা পেয়েছি এবিএম মূসার অনুজ সহকর্মী হিসেবে । কারণ মূসা ভাই ছিলেন বাংলাদেশে পরিবেশ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ।

অনেকে হয়তো জানেন না- বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ছিলেন আফেজের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। অনেকে জানেন না ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির আঞ্চলিক তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যোগ দেন ব্যাংককে। এখানে কিংবদন্তি সাংবাদিক এবিএম মূসার কেটেছে বেশ ক’বছর । আমাদের সবার প্রিয় মূসা ভাই টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ নিয়ে সেজন্য সব সময় ছিলেন সোচ্চার। নিমতলীর অগ্নিকান্ড তাকে বেদনাহত করতো । নিমতলী ট্র্যাজেডি’র পর গঠিত কমিটির ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে ক্ষমতাবানদের অনীহা তাকে পীড়িত করতো । সবাই তাঁকে চেনেন এক দিকপাল সাংবাদিক হিসেবে। সুদীর্ঘ ৬০ বছরের বেশি সময় জুড়ে তিনি সক্রিয় সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালে কলেজ ছাত্র থাকাকালে শুরু করেন সাংবাদিকতা। চৌমুহনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক কৈফিয়ত পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে হাতেখড়ি তাঁর বর্ণাঢ্য সাংবাদিক জীবনের। এরপর যোগ দেন দৈনিক ইনসাফে। পরে পাকিস্তান অবজারভারে তাঁর সাংবাদিকতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। তদানীন্তন কালে এই ইংরেজি দৈনিকের প্রতাপশালী বার্তা সম্পাদক হিসেবে এদেশে সাংবাদিকতার বিকাশে এবিএম মূসা রেখেছেন অনন্য সাধারণ অবদান। কমনওয়েলথ প্রেস ইনস্টিটিউট লন্ডন থেকে ষাটের দশকে তিনি সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেন। কাজ করেন বিবিসি-সানডে টাইমসে।

সাংবাদিকতার নানা বিভাগে বিচিত্র সব কাজ করেছেন আমাদের প্রিয় মূসা ভাই। উন্নয়ন সাংবাদিকতা, পরিবেশ সাংবাদিকতা, ক্রীড়া সাংবাদিকতা ছাড়িয়ে ছাপিয়ে তিনি রাজনৈতিক সাংবাদিক, কলাম লেখক, টিভি টক শো’র তী² তির্যক জনপ্রিয় আলোচক হিসেবে দেশব্যাপী বেশি পরিচিতি পেয়েছেন ।

কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার বাইরে এখনো বিশ্বের নানান দেশে মূসা ভাই টেকসই উন্নয়ন সাংবাদিকতা, পরিবেশ সাংবাদিক হিসেবেই সুপরিচিত। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তর বলুন, ব্যাংককে ইউএন এসকাপ বলুন কিংবা নাইরোবিতে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির সদর দপ্তরে গিয়ে এখনো আমি তাঁর বন্ধু সহকর্মীর সান্নিধ্য পাচ্ছি।

কথা ছিল বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের (এফইজেবি) ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা মূসা ভাইয়ের জীবিত সব বিদেশি উন্নয়ন সাংবাদিক বন্ধুদের নিয়ে এক মিলনমেলার আয়োজন করবো ঢাকায়। মূসা ভাই সেজন্য তাড়া দিচ্ছিলেন আমাকে। কিন্তু তখন বুঝিনি তিনি কেন অতো তাড়া দিচ্ছিলেন। আজ বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। কিন্তু নেই মূসা ভাই আমাদের মাঝে।

জাতীয় প্রেস ক্লাব লাউঞ্জ, ক্যান্টিন কতো জায়গায় মূসা ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডায় বসেছি। তিনি সেসব আড্ডায়-চায়ের টেবিলে সাংবাদিকতার নানা প্রসঙ্গে তাঁর জীবনঘেঁষা ভাবনা সহজ সরল করে চমৎকারভাবে তুলে ধরতেন। অবশ্যই হাস্য কৌতুক থাকতো। হোজ্জার গল্প থাকতো। মওলানা রুমির কোটেশন থাকতো। নিসর্গ, প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে আসতো। নদ-নদী দখল, বন-বাদাড়-খাল বিল উজাড় নিয়ে কথা হতো। পরিবেশ আন্দোলনের ভুলভ্রান্তি তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন। পরিবেশ ও উন্নয়ন প্রতিবেদনে তৈরি করা যায়, সে সুপরামর্শ দিতে কখনো কার্পণ্য করতেন না তিনি।

উন্নয়ন সাংবাদিকতার সংজ্ঞা নিয়ে, পরিবেশ সাংবাদিকতার ব্যাপ্তি নিয়ে মূসা ভাইয়ের সঙ্গে বিতর্ক করা যেতো। দ্বিমত পোষণ করা যেতো। যুক্তির কাছে তিনি হার মানতে কুণ্ঠিত হতেন না। অনুজপ্রতিমদের ভুল শুধরে দিতেন, নিজের ভুল আমরা ধরিয়ে দিলে কাবাব, মিষ্টি, চা খাওয়াতেন। সবুজ বিপ্লবের সুফল-কুফল, উফশী বীজ, সার-কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, দেশীয় ধানের নানা জাতের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তাঁর ছিল গভীর উৎকণ্ঠা। দূষণ আর পাহাড় কাটা নিয়ে ছিলেন ভীষণ উদ্বিগ্ন। দৈনিক সংবাদ-এর আশির দশকের শেষের দিকে তিনি উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। আমি ছিলাম অর্থনৈতিক সম্পাদক ও সিনিয়র রিপোর্টার। সে সময় তিনি এবং সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত আহমদুল কবির ও বজলুর রহমান আমাকে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ বিষয়ক নানা প্রতিবেদন লেখায় উৎসাহ জোগাতেন অকৃপণভাবে।

পশ্চিমা ঢঙে পরিবেশ সাংবাদিকতা এদেশে অচল। আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশ ভিন্ন। উন্নয়নের দৌড়ে আমরা অনেক পেছনে। কিন্তু পরিবেশ, জলবায়ু, টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন তৈরিতে আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো? আমরাও তো পারি এক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে।

তাঁকে বলতাম সাংবাদিকতা হচ্ছে চটজলদি সাহিত্য। পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতার বেলায় তা আরো বেশি প্রযোজ্য। পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিবেদন লেখার সময় তাই সাহিত্যের আশ্রয় নিতে হয়। কবিতার মতো প্রতিবেদনকে শুদ্ধ করে তুলতে হয় । পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকের চোখে কবির তী² তির্যক দৃষ্টি থাকতে হয় । তিনি কখনো কখনো প্রশ্ন করতেন, ‘তুই ধূসর বিবর্ণ দূষণে রঙ পাবি কৈ? বুড়িগঙ্গার পানি তো পেলিক্যান কালির চাইতেও কালো । ঐখানে রঙ মাখবি কেমনে? মূসা ভাইকে পাল্টা বলতাম, ‘কেন পেলিক্যানের কালিও তো রঙ । হাজারিবাগের ট্যানারির বর্জ্য, গার্মেন্টসের কাপড়ের রঙও তো বুড়িগঙ্গায় পড়ে? এমনতরো নানা আলোচনা আমরা করেছি কতোবার, কতো সময়- গত কয়েক দশকে মূসা ভাইযের সঙ্গে। ভালো রিপোর্ট করলে তিনি প্রশংসা করতেন, খাওয়াতেন। কোনো রিপোর্টে ফাঁকি দিলে, ভুল হলে তিনি বকাবকি করতে ছাড়তেন না।

অনেক কাছ থেকে দেখেছি প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি সাংবাদিক প্রয়াত এনায়েতুল্লাহ খান, এসএম আলী আর শহীদুল হক কতো সমীহ করতেন মূসা ভাইকে। দেখেছি ইউএন এসকাপের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এসএমএস কিবরিয়া এবং ড. কে এফ জালালসহ জাতিসংঘের পদস্থ কর্মকর্তারা কিভাবে মূসা ভাইকে সম্মান করতেন।

ইউএন এসকাপ ভবনে মূসা ভাইয়ের দিনগুলো ছিল বর্ণিল। উন্নয়ন আর পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদন পরিসংখ্যানে ভারাক্রান্ত হোক, তা মূসা ভাই কখনো চাইতেন না। রিপোর্টে তিনি আমাদেরকে তথ্যের সঙ্গে পরিসংখ্যান যোগ করে দিতে বলতেন। কিন্তু অপ্রয়োজনীয়ভাবে অতিরিক্ত পরিসংখ্যান বর্জন পছন্দ করতেন।

বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন আর পরিবেশ আন্দোলন বেশ জোরদার হয়েছে গত কয়েক দশকে। আশির দশকে এই আন্দোলনের সূচনালগ্নে বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের (এফইজেবি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে মূসা ভাই ছিলেন সম্মুখ কাতারে। খ্যাতিমান সাংবাদিক তোয়াব খান, তাহমিনা সাঈদ, সৈয়দ কামালউদ্দিন, আহমেদ নূরে আলম, শেহাবউদ্দিন নাফা, গাজীউর রহমান, শামসুদ্দিন পেয়ারা, বদিউল আলম, চিন্ময় মুৎসুদ্দী, চন্দন সরকার, ফজলুর বারী, মনোয়ার হোসেনসহ অনেকে মিলে গোড়াপত্তন করেন এফইজেবির। তাঁদের সকলের কাছে আমরা ঋণী। জাতীয় প্রেস ক্লাবে সকাল-সন্ধ্যা এলেই আমার মনে পড়ে তাঁর সেই সদা হাস্যোজ্জ্বল প্রিয় মুখ। আমার বর্তমান কর্মস্থল বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় ঢুকলেই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে অগ্রজ পথিকৃৎ পরিবেশ সাংবাদিক এবিএম মূসার নানা কীর্তি। তাঁর কাছে আমার অশেষ ঋণ। কোনোকালে সে ঋণ শোধ হবার নয়।

মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগেও আমার কাছে তাঁর শেষ অনুরোধ ছিল পরিবেশ আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে যেন বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের পক্ষ থেকে আমরা সংবর্ধনা দেই । সেখানে তিনিও উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে আয়োজন করা আর সম্ভব হয়নি। ভেবেছিলাম, তাঁকেও আমরা আজীবন সম্মাননা দেব। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি আমরা বিনম্র শ্রদ্ধ জানাই ।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম ও এশিয়া-প্যাসিফিক পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।