সুউচ্চ আর সুন্দর ভবন নির্মাণের পথিকৃৎ তিনি

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।

ঢাকার চারদিকে তাকালে সুউচ্চ বা সবচেয়ে সুন্দর ভবন বা স্থাপনা চোখে পড়বে, তার একটি অবশ্যই কনকর্ড গ্রুপের বানানো। আর কনকর্ড গ্রুপ মানেই এস এম কামালউদ্দিন। তিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পাস করে ঢুকেছিলেন এক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে। সেখানে কাজ করেন আট বছর। তারপর নিজেই স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠা করেন কনকর্ড নামের এক কোম্পানি।
তখন বাংলাদেশ সদ্য একটি দেশ। দেশজুড়ে চলছে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজ। ঠিক সেই সময়ে, ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা হলো কনকর্ডের। শুরুতে কনকর্ড কনস্ট্রাকশন ছিল খুবই ছোট একটা কোম্পানি। তখন দেশে রাস্তাঘাট তেমন নেই, মুক্তিযুদ্ধে বড় অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে, বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেতু, বন্দর ঠিকমতো ব্যবহার করা যাচ্ছে না, বিমানবন্দরের অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। ঠিক সে সময়ে নির্মাণ কোম্পানি গঠন করে কাজে লেগে গেলেন এস এম কামালউদ্দিন।

এস এম কামালউদ্দিন

প্রথম কাজটি ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ক্ষতিগ্রস্ত সাতটি সেতুর পুনর্নির্মাণ। সেই যে কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের যাত্রা, তা আজও অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ বিনির্মাণের সঙ্গে প্রায় প্রথম থেকেই জড়িয়ে আছেন এস এম কামালউদ্দিন। আর এখন দেশের অন্যতম বড় নির্মাণ কোম্পানি তারা। বহুমুখী কাজের সঙ্গে যুক্ত কনকর্ড। দেশের অনেক নতুন কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে কনকর্ড গ্রুপ বা এস এম কামালউদ্দিনের নাম। এখন আর কেবল নির্মাণকাজ নয়, রিয়েল এস্টেট, পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী উৎপাদন, থিম পার্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় নাম কনকর্ড গ্রুপ। কেবল দেশে নয়, দেশের বাইরে নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তারা।

মতিঝিলের ২০তলা শিল্প ব্যাংক ভবন, ২২তলা জীবন বীমা ভবন, জনতা ব্যাংকের ২৪তলা প্রধান কার্যালয়—এগুলো সবই সেই ৮০ ও ৯০ দশকের মধ্যে নির্মাণ করেছিল কনকর্ড। বাংলাদেশ স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের কার্যালয় ভবন, তিতাস গ্যাসের প্রধান কার্যালয়, টিঅ্যান্ডটি ভবন, বিমানবন্দরে ভিআইপি টার্মিনাল—এ রকম অসংখ্য ভবন ও স্থাপনা কনকর্ডের তৈরি। তবে এস এম কামালউদ্দিনের অন্যতম গৌরবময় কীর্তি হচ্ছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর বঙ্গভবনের সংস্কার এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষ নির্মাণও করেছে এই গ্রুপ। কনকর্ডকে দেশের বাইরেও নিয়ে গেছেন এস এম কামালউদ্দিন। মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি এবং সিঙ্গাপুরে একটি ভবন তৈরি করেছে এই গ্রুপ। সব মিলিয়ে দেশের মধ্যে এক হাজারের বেশি প্রকল্প নির্মাণের সঙ্গে জড়িত কনকর্ড গ্রুপ।

শাহরিয়ার কামাল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কনকর্ড

এস এম কামালউদ্দিন কেবল ভবন নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। ভবন নির্মাণে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী নির্মাণসামগ্রী তৈরিতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তারাই প্রথম ভবন নির্মাণে ইটের পরিবর্তে হলো ব্লকের ব্যবহার শুরু করে। বালু, সিমেন্ট ও নুড়ি পাথর দিয়ে এই হলো ব্লক তৈরি করা হয়। এর ব্যবহারে নির্মাণ ব্যয়ও কম। বলা হয়, হলো ব্লক ব্যবহার করা হয় তাহলে ব্যয় অন্তত ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে। কারণ, একটি ব্লক পাঁচটি পোড়া ইটের সমান।

৯০-এর দশকে দেশে ব্লকের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করেছিল হাউস অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই)। আর ১৯৯৮ সালে কনকর্ড গ্রুপ বাণিজ্যিকভাবে ব্লকের উৎপাদন শুরু করে। তারা নিজস্ব সব ভবন নির্মাণেই এই ব্লক ব্যবহার করছে। বর্তমানে কনকর্ড তিনটি কারখানায় হলো ব্লক তৈরি করছে। অন্যরাও তাদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে। কনকর্ড শুরু করেছিল, এখন সেই পথ ধরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখন বাণিজ্যিকভাবে ব্লক তৈরি করছে। পোড়া ইটের পরিবর্তে হলো ব্লক ব্যবহার করতে এখন সরকারও তাগিদ দিচ্ছে।

গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহরিয়ার কামাল কিছুদিন আগে প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, কনকর্ড গ্রুপের চেয়ারম্যান এস এম কামালউদ্দিন ১৯৭৩ সালে গড়ে তোলেন এ প্রতিষ্ঠানটি। এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নির্মাণ করেছে কনকর্ড। তার মধ্যে সাভারের স্মৃতিসৌধ, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শিল্প ব্যাংক ভবন, ইনডোর স্টেডিয়াম, আইডিবি ভবন, কনকর্ড পুলিশ প্লাজা অন্যতম।

শাহরিয়ার কামাল আরও বলেছিলেন, ‘বাবা যখন আবাসন ব্যবসা শুরু করেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলেন ঢাকা মেগা সিটিতে রূপ নেবে। এ চাপ সামলানোর উপায় হলো সব সুযোগ-সুবিধা কাছাকাছি হতে হবে, পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এ জন্য লেকসিটি কনকর্ডের মতো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। শুধু প্রকল্প হাতে নিয়েই বসে ছিলেন না এস এম কামালউদ্দিন, পাশাপাশি প্রকল্পটি যেন পরিবেশবান্ধব হয়, খোলামেলা থাকে, বাচ্চাদের খেলাধুলার জায়গা থাকে, এ চিন্তাও করেছিলেন। লেকসিটি প্রকল্পে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহার করতে ১৯৯৮ সালে গড়ে তোলেন কনকর্ড রেডি মিক্সড অ্যান্ড কংক্রিট প্রোডাক্টস লিমিটেড। এটা নতুন কোনো প্রযুক্তি ছিল না, সারা বিশ্বে বেশ আগে থেকেই এমন ইট ব্যবহার হচ্ছে।’

১৯৯৮ সালের পর প্রায় ২০০টি প্রকল্প করেছে কনকর্ড। এর সব কটিতেই ব্যবহার করেছে পরিবেশবান্ধব ইট, হলো ব্লক, ইউনিপেভার্স ও টাইলস। এখনো সব ভবন ও সড়কেও এসব সামগ্রী ব্যবহার করছে।

এমনিতেই ঢাকাসহ দেশের কোথাও বিনোদন বা সময় কাটানোর জায়গার খুব অভাব। এদিক থেকেও কনকর্ড ছিল অন্যদের তুলনায় কয়েক ধাপ এগিয়ে। একাধিক থিম পার্ক নির্মাণ করে লাখ লাখ মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা করেছে তারা। ঢাকার আশুলিয়ায় ফ্যান্টাসি কিংডম কমপ্লেক্স এবং চট্টগ্রামের ফয়েজ লেকের এই থিম পার্ক এখন জনপ্রিয় দুটি নাম।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম অগ্রনায়ক এস এম কামালউদ্দিন। এখন অবশ্য পরের প্রজন্ম প্রবেশ করেছে কনকর্ড গ্রুপে। শাহরিয়ার কামাল এখন গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক।