ইংরেজি ভাষা শেখা হারাম ফতোয়াঃ একটি ইতিহাস বিকৃতি

ইংরেজি ভাষা শেখা হারাম  ফতোয়াঃ একটি ইতিহাস বিকৃতি
ইংরেজি ভাষা শেখা হারাম  ফতোয়াঃ একটি ইতিহাস বিকৃতি


মুফতি রেজাউল করিম, মুহাদ্দিস, সুফফাহ মাদরাসা, মহেশপুর

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আশা করছি আল্লাহর রহমতে ভাল আছেন। আজ আমি আলোচনা করব আবু তহা মোহাম্মদ আদনানের ইতিহাস বিকৃতির জবাব।  আপনারা সকলেই হয়তো দেখেছেন ইদানিং ফেসবুকসহ অন্যান্য সাইটে তহা মোহাম্মদ আদনানেরএকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।  যেখানে তিনি দাবি করেছেন আলেম উলামারা ইংরেজি শিক্ষাকে হারাম ঘোষণা করেছিলেন । সুতরাং আজকের বিষয়বস্তু হলো,  সত্যিই কি আলেমগণ ইংরেজি শিক্ষাকে হারাম ঘোষণা করেছিলেন নাকি আবু তহা মহম্মদ আদনান ইতিহাস বিকৃতি করেছেন? বা ইংরেজি ভাষা শেখা হারাম ফতোয়াঃ একটি ইতিহাস বিকৃতি।  আজকের এই প্রবন্ধে আমি প্রমাণ করব যে, আবু তহা মোহাম্মদ আদনান ইতিহাস বিকৃত করেছেন। আলেম উলামারা কোনোকালেই ইংরেজির বিপক্ষে ছিলেন না। তারা কখনোই ”ইংরেজি শিক্ষা করা হারাম” এই ফতোয়া দেননি। তাহলে আসুন জেনে নেই মূল ঘটনা ।


আমার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন: Rezaul Karim official


প্রায় দুই শ’ বছর ধরে উপমহাদেশে একটি কথা ছড়িয়ে রয়েছে। তা হলো,  "আলেমরা ইংরেজি ভাষা শেখা হারাম মর্মে ফতোয়া দিয়েছেন"।
কিন্তু ফতোয়াটির উৎস বা সূত্র কেউ উল্লেখ করেন না৷ অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেন না। ফতোয়াটি কে দিয়েছিলেন? সেটি কোথায় আছে?  তার কোনো পাত্তা নেই। কেউ কথাটি বাতাসে ছেড়ে দিয়েছে। আর জনসাধারণ তা বিশ্বাস করে আলেমদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে রেখেছে। এমনকি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ তো অনুসন্ধান বা যাচাই ছাড়াই নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিছে দেহলবী রহ: ইংরেজি শিক্ষা হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।

ইংরেজী ভাষা শিক্ষা করা  জায়েয৷ এর পক্ষে আমি তৎকালিন ৩ জনের ফতোয়া উল্লেখ করছি-

১৷ উলামায়ে দেওবন্দের মাথার মুকুট হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী রাহ. (১২৯৭ হি., ১৮৭৯ ঈ.)

ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করে একে দাওয়াতের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার আকাংখা প্রকাশ করেছিলেন। নিম্নে একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি। ‘দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা শেষ জীবনে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, আমি যদি ইংরেজি জানতাম তাহলে ইউরোপের পাণ্ডিত্যের দাবিদারদের সামনে ঘোষণা দিতাম যে, তোমরা যাকে জ্ঞান মনে কর তা আদৌ জ্ঞান নয়; বরং জ্ঞান হল যা নবীদের (আ.) সিনা থেকে বেরিয়ে আলোকিত অন্তরে এসে অবস্থান নিয়েছে।

(আর-রশীদ, দারুল উলূম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ১৬৪)

২৷ হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. এক প্রশ্নের উত্তরে লেখেন, ইংরেজি ভাষা শেখা জায়েয। (ফাতাওয়া রশীদিয়াহ পৃ. ৫৭৪)

৩৷ হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী রাহ.-এর সমসাময়িক বিখ্যাত আলেম, হযরত মাওলানা আবদুল হাই লক্ষ্ণভী রাহ. লেখেন, (তরজমা) ‘ইংরেজি পড়া ও ইংরেজি শেখা জায়েয যদি এতে দ্বীনদারীর ক্ষতি না হয়।’ (ফাতাওয়া মাওলানা আবদুল হাই লক্ষ্ণভী, ২/২৩৩)

৩৷ শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ. ১৯২০ ঈ. সালে মাল্টার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যখন ভারতে পৌঁছলেন তখন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাওয়াতে আলীগড় গিয়েছিলেন। সেখানে বলেছিলেন, ‘ওলামায়ে কেরাম কখনো ইংরেজি ভাষায় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে নিষেধ করেননি।’

( আর রশীদ, দারুল উলূম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ৬৬০ ইমদাদুল ফাতাওয়া ৫/১৫৬-১৫৭ )


আরোও পড়ুনঃ  আলেমদের মাওলানা বলা কি হারাম?


অন্যান্য ভাষার মতো ইংরেজিও একটি মোবাহ ভাষা, কিন্তু আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কারণে তা দোষযুক্ত হয় ...। যদি কেউ সেইসব অনুষঙ্গ থেকে মুক্ত থাকে অর্থাৎ তার আকীদা-বিশ্বাস বিনষ্ট না হয়, যার সহজ বরং একমাত্র পথ হচ্ছে, ইলমে দ্বীন হাসিল করে চিন্তা-চেতনায় তা বদ্ধমূল রাখা এবং আমল-আখলাকও নষ্ট না হয়, সংকল্পও এই থাকে যে, এর দ্বারা জীবিকা উপার্জনের শুধু এমন পথ অবলম্বন করব, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয। অতঃপর কার্যক্ষেত্রেও এ নীতির উপর অটল থাকে, তো এমন ব্যক্তির পক্ষে ইংরেজি শেখা জায়েয ও মোবাহ। আর যদি নিয়ত এই থাকে যে, একে দ্বীনের খেদমতের জন্য ব্যবহার করবে তবে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে ...। মোটকথা, ইংরেজি কখনো হারাম, কখনো মোবাহ এবং কখনো ইবাদত।’’

এই ফতোয়ার পরও  যারা উলামায়ে দেওবন্দ সম্পর্কে উপরোক্ত প্রপাগাণ্ডা ছড়ায় তাদেরকে ইতিহাস বিকৃতকারী ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? এখন প্রশ্ন হল, এ প্রপাগাণ্ডার উৎস কী?

উৎস বলার আগে আসুন একটু ইতিহাস পড়ে নেই ৷
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর বৃটিশরা মুসলমানদেরকেই একমাত্র প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করল। তাই রাষ্ট্রের যে কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করল। তারা ভাবতে লাগল, শিক্ষায় যদি এদেরকে বিকলাঙ্গ করা না যায় তাহলে এদের মাথা থেকে ক্ষমতা দখল ও উন্নত মম শিরের স্বপ্ন দূর করা যাবে না। (আর-রশীদ, দারুল উলূম দেওবন্দ পৃ. ১৯৭)

এখানে বৃটিশরা এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করল : ১. মুসলমানদের উপর মূর্খতাকে চাপিযে ভারতে শাসন ক্ষমতাকে নিঃষ্কন্টক করল
২. আমাদেরকে তোমরা পরিকল্পিতভাবে মূর্খ বানিয়ে রেখেছ-এ অভিযোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষার দানাকে বৃটিশের প্রতি বিদ্বেষের মালায় গেঁথে দিল। আর এই অপকৌশলকে জোরে সোরে উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডা চালাতে লাগল যে, তারাই হারাম ফতোয়া দিয়ে ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষা থেকে তোমাদেরকে বঞ্চিত করছে।


এই প্রপাগাণ্ডা দ্বারা ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দুটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য পূরণে সফল হয়েছে : 

১. সাধারণ মুসলমান ও আলিমদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি, যা আজও দূর হয়নি। কারণ এই প্রচারণার দ্বারা সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, আলিমদের কথা শুনলে মূর্খ হয়ে থাকতে হবে এবং একশত বছর পিছিয়ে যেতে হবে। তদ্রূপ আলিমদের মাধ্যমে মসজিদ-মাদরাসা, দুআর অনুষ্ঠান ইত্যাদি পরিচালনা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র এবং আইন ও আদালত চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।


২. উপমহাদেশের সাধারণ মুসলমান একসময় বৃটিশ রাজশক্তিকে আযাব মনে করে তা থেকে নিস্কৃতি লাভের চেষ্টা করত। কিন্তু এইসব প্রপাগাণ্ডার পর তারা বৃটিশকে রহমত আর উলামায়ে কেরামকে উন্নতি-অগ্রগতির পথে অন্তরায় বলে মনে করতে আরম্ভ করল। বলাবাহুল্য, কোনো জাতি যখন তার আদর্শবান ও কল্যাণকামী অংশকে প্রতিপক্ষ মনে করতে থাকে এবং আদর্শহীন ও স্বার্থবাদী সমপ্রদায়কে মিত্র মনে করে তখন তাদের ধ্বংস ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়।


                      আরোও পড়ুনঃ মুসাফাহা দুই হাতে করা সুন্নাত না এক হাতে? 

সত্য প্রকাশ

My name: Mufti Rezaul Karim. I am teaching in a communal madrasah, I try to write something about Deen Islam when I have time because I have a fair amount of knowledge about online. So that people can acquire Islamic knowledge online. You can also write on this blog if you want.

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন